
সময়ের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ....
সময়ের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ....
============ শেষ পর্ব ================
সময় সম্পর্কে এই আবর্তক ধারণা মানুষের মনে বেশ জোরালো প্রভাব ফেলেছিল। প্রাচীন ভারতীয়দের কৃষিনির্ভর সমাজব্যবস্থায় এই ধারনাই স্থায়ী আসন করে নেয়। তবে প্রাচীন ভারতীয়দের আবর্তক ধারণা কিছুটা আরও ব্যাপক আকারের। ওরা মনে করত- একই ঋতু বার বার ফিরে আসা, বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনা ফিরে ফিরে ঘটা বা গ্রহদের ফিরে আসাই শুধু না; বরং সমগ্র মহাবিশ্বের সকল ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হবে, আবার ধ্বংস হবে; আর এভাবে চলতেই থাকবে। প্রাচীনকালের বেশিরভাগ সভ্যতাই ছিল কৃষিনির্ভর। তাই এই আবর্তক ধারণা প্রায় সব প্রাচীন সমাজেই প্রভাব ফেলেছিল।
প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে সময় নিয়ে সবচেয়ে সচেতন ছিল মধ্য অ্যামেরিকার মায়া সভ্যতা। মায়ানরাই সর্বপ্রথম নির্ভুলভাবে সময় হিসেব করতে শিখেছিল। ওরা জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভিত্তিতে গণনা করে খুব আধুনিক একটি ক্যালেন্ডার তৈরি করেছিল। ভাবতে অবাক লাগবে- আধুনিক সময় গণনার ভিত্তি হিসেবে আমরা যে গেগ্ররি ক্যালেন্ডার ব্যাবহার করি, মায়াদের ক্যালেন্ডার তার থেকেও নির্ভুল ছিল। কারণ, গেগ্ররি ক্যালেন্ডার প্রতি দশ হাজার বছরে তিনদিন পিছিয়ে যায়; আর মায়াদের ক্যালেন্ডার প্রতি দশ হাজার বছরে মাত্র দুই দিন এগিয়ে থাকে।
মানব সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষের মন থেকে বিভিন্ন প্রকার ম্যাজিক্যাল ধারণা দূর হতে থাকে। সেই সাথে সময় সম্পর্কেও ম্যাজিক্যাল ধারণা বাতিল হয়ে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা শুরু হতে থাকে। জার্মান জ্যোতির্বিদ জোহানেস কেপলারই প্রথম সময়ের বৈজ্ঞানিক ধারনার উপর জোর দেন। তিনি সময়কে প্রানবাদ ও ম্যাজিক্যাল ধারণা থেকে মুক্ত করে, পুরো মহাবিশ্বটিকেই একটি যাত্রিক ঘড়ি হিসেবে দেখার প্রস্তাব করেন । পরবর্তীতে কেপলারের এই “যাত্রিক ঘড়ি” ধারনার বিকাশ ঘটান রেনে ডেকার্তে, বেঞ্জামিন থম্পসন, লর্ড কেলভিনের মত বিজ্ঞানীরা । মূলত তাদের চিন্তাধারাই সময়ের ক্ষেত্রে একটি বিপ্লবাত্মক চেষ্টা ছিল।
লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন- উপরে বিভিন্ন প্রাণীর সময়-জ্ঞান নিয়ে আলোচনা করা সময় একটি বিষয়ের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে, সেটি হলো- “ কে কত দূরভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে পারে”। কারন, যে প্রাণী যত বেশিদূর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে বা পরিকল্পনা করতে পারে, তার সময়-জ্ঞান তত বেশি সূক্ষ্ম। সময়ের উপর থেকে ম্যাজিক্যাল ধারণা দূর হবার আগ পর্যন্ত আমরা আসলে খুব বেশিদূর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতেও পারতাম না। আর একই কারনে খুব বেশিদূর অতীত নিয়েও ভাবতে পারতাম না। ফলে এই পৃথিবী ও মহাবিশ্বটা আমাদের কাছে খুব বেশি পুরনো ছিল না। ডেকার্তে-কেপলারের বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা শুরু হবার আগে পুরো ইউরোপে জুড়ে সেমেটিক বিশ্বাসই ছিল সবক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। সেমেটিক বিশ্বাস অনুযায়ী, এই মহাবিশ্বের সবকিছুর সৃষ্টি মাত্র কয়েক হাজার বছর আগে। ফলে তার আগের বিষয় নিয়ে ভাবার কোন দরকারই ছিল না। কিন্তু বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা শুরু হবার পর বৈজ্ঞানিকভাবে পৃথিবীর বয়স নির্ধারণের চেষ্টা চলতে থাকে।
কমটি ডি বাফুন নামে এক ফরাসি গণিতবিদ প্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে পৃথিবীর বয়স নির্ধারণ করেন। তার হিসেবে দেখা যায় – পৃথিবীর বয়স কমপক্ষে পঁচাত্তর হাজার বছর। পরবর্তীতে পৃথিবীর বয়স নির্ধারণের সঠিক উপায় আবিষ্কারের পর দেখা যায় পৃথিবীতে কয়েক শত কোটি বছর পুরনো পাথরের অস্তিত্ব রয়েছে ।আর মহাবিশ্ব সৃষ্টির আধুনিক তত্ত্ব থেকে দেখা যায় ১৩.২ বিলিয়ন বছর আগে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি। মহাবিশ্ব সৃষ্টিরও কয়েকশত কোটি বছর পরে, মাত্র ৪৫০ কোটি বছর আগে আমাদের এই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল। বিজ্ঞানের তত্ত্বের সাহায্য নিয়ে আমরা আজ থেকে ৫০০ কোটি বা তারও বেশি সময় পরে এই পৃথিবী-সৌরজগতের অবস্থা কেমন হবে সেটাও ভাবতে পারছি। মূলত সৌরজগতের বিবর্তনের বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হবার আগ পর্যন্ত আমাদের কাছে বৃহৎ সময় বলে তেমন কিছু ছিল না বললেই চলে। কিন্তু মহাবিশ্ব সৃষ্টির তত্ত্ব পাবার পর সময়ের অনেক বড় পর্যায় পর্যন্ত আমরা ভাবতে পারি । এমনকি সময় শুরু এবং শেষ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমরা ভাবতে পারি। অনেক বড় সময়ের পাশাপাশি অনেক ক্ষুদ্র সময় নিয়েও আমরা ভাবতে পারি। এখন আমাদের এক সেকেন্ডের কয়েক কোটিভাগের মধ্যে ঘটে যাওয়া কোয়ান্টাম কণিকার সংঘর্ষের পরিণতি মাপতে হচ্ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে- মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধির সাথে সাথে আমাদের সময়-জ্ঞান দিন দিন বিস্তৃত ও সূক্ষ্ম হচ্ছে।
0 Response to "সময়ের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ...."
Post a Comment