প্রকৃত বন্ধু -মুনাওয়ার শাহাদাত
Home তোমাদের গল্প প্রকৃত বন্ধু -মুনাওয়ার শাহাদাত
প্রকৃত বন্ধু -মুনাওয়ার শাহাদাত
মে, ২০১৭
রনি ও জনি দুই বন্ধু। ওরা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। রনি ক্লাসের ফার্স্টবয়। আর জনি কোনো মতে পাসটা করে। গত পরীক্ষায় এক বিষয় ফেলও করেছিল। তার বাবা ভ্যানচালক। তিনি কোনো মতে তাদের চার সদস্যের পরিবারটিকে চার ক্রোশ চলার পর নেতিয়ে পড়া ক্লান্ত ঘোড়ার মতো টেনেহিঁচড়ে চালিয়ে নিচ্ছেন। এত কষ্টের মাঝেও তিনি চান; তার ছেলে লেখাপড়া করে বড় চাকরি করুক, তার মতো ভ্যানচালক না হোক। তার স্বপ্ন; ছেলে বড় হয়ে টাকা পয়সা রোজগার করে ঝিমিয়ে পড়া সংসারটার হাল ধরবে। তার জন্য তিনি সব রকম কষ্ট হাসি মুখে সইতে রাজি। অথচ জনির পড়ায় এমন উদাসীনতায়, তিনি খুবই মর্মাহত।
আজ মডেল টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশিত হয়েছে। এবার জনি একটি নয়, তিন তিনটি বিষয়ে ফেল করেছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, জনিকে সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হবে না। কারণ তিনি চান না, জনি বরাবরের মতো সমাপনীতেও ফেল করে বিদ্যালয়ের সুনাম নষ্ট করুক।
জনির বাবা একটি মাত্র সুযোগ দেয়ার জন্য কত অনুনয় বিনয় করলো, তবু প্রধান শিক্ষক তার সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও নড়লেন না।
অবশেষে রনি নিজে প্রধান শিক্ষককে খুব সম্মানের সহিত জনির পরীক্ষায় পাসের প্রতিশ্রুতি দিয়ে একটিবার তার পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি নিতে সক্ষম হলো।
রনি স্যারকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘স্যার আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, ইনশাআল্লাহ জনি এবার সব বিষয়ে পাস করবে। আমি তাকে সব রকম সহযোগিতা করবো।’
জনির বাবা রনিকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে বলতে লাগলেন, ‘বাবা, তুমি আজকে আমার লালিত স্বপ্নগুলোকে অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে নতুন জীবন দান করলে। আমি দোয়া করি, তুমি অনেক বড় হবে। এবার তুমি ওকে একটু বোঝাও, সে যেন এখন থেকে আরেকটু মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে।’
জনি রনিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলো। রনি প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। পরে নিজেকে সামলে নিয়ে জনিকে নিজের গা থেকে পৃথক করে তার অসহায় হরিণের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা অশ্রুভেজা চোখগুলো মুছে দিয়ে বলল; ‘আরে পাগল কাঁদছিস কেন? আমি আছি তো, তুই এবার সমাপনী পরীক্ষায় ঠিকই পাস করবি। আমি তোকে সহযোগিতা করবো।’
ক্লাসের সকল ছাত্র কোচিং করলেও জনির মতো ভ্যানচালক, দিনমজুর বাবার ছেলেরা টাকার অভাবে কোচিং করতে পারে না। এ দিকে জনি রনির সহযোগিতায় তার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে লাগলো নতুন উদ্যমে। প্রতিদিন ক্লাস শেষে ও বিরতির ফাঁকে ফাঁকে রনি জনিকে গণিত, ইংরেজিসহ বিজ্ঞানের মতো কঠিন বিষয়গুলো বুঝিয়ে দিতে লাগলো। এভাবে অল্পদিনের মধ্যে রনির সহযোগিতায় জনির সবগুলো বিষয় একবার রিভাইজ দেওয়া শেষ হয়ে যায়।
পরীক্ষা শুরু হতে মাত্র পাঁচ দিন বাকি। জনি সব ক্লেশ ও অলসতা ঝেড়ে সারাদিন বই নিয়ে পড়ে থাকে। তাকে আর আগের মতো পড়ার টেবিলে বসতে বলতে হয় না। সে অনুভব করে, তার ভেতর এক নতুন জনিকে। যার জন্ম হয়েছে তার প্রকৃত বন্ধু রনির স্পর্শে। সে ভাবে; বন্ধু হলে এমন হওয়া উচিত!
সেদিন যদি রনি এগিয়ে না আসতো, তাহলে হয়তো তার আর তার গরিব বাবার স্বপ্নগুলো আজীবন স্বপ্ন হয়েই অদৃশ্য থেকে যেত, এ পৃথিবীর মুখ আর দেখতে পেত না!
বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতায় জনির চোখ দুটো ভিজে গেল !
পরীক্ষা শুরু হয়েছে আজ তিন দিন। এরই মধ্যে তিনটা বিষয়ের পরীক্ষা হয়েও গেল। চতুর্থ দিন পরীক্ষা শেষে ফেরার পথে প্রধান শিক্ষকের সাথে তাদের দুই বন্ধুর সাক্ষাৎ হলো। সালাম বিনিময়ের পর স্যার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের পরীক্ষা কেমন হচ্ছে?’ তারা উভয়ে জানালো পরীক্ষা আলহামদুলিল্লাহ ভালো হচ্ছে স্যার। স্যার রনিকে বললেন, ‘কী রনি এ প্লাস থাকবে তো?’ রনি বললো, ‘আপনাদের দোয়া থাকলে ইনশাআল্লাহ থাকবে স্যার।’ এবার স্যার জনিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘জনি, তোমার পরীক্ষা কেমন হচ্ছে? তোমার বন্ধুর এবং বিদ্যালয়ের মান রাখতে পারবে তো?’ জনি প্রত্যুত্তরে কেবল হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো ।
আজ দেশের প্রায় সব ক’টি জাতীয় পত্রিকায় বড় অক্ষরে ছাপা হয়েছে; ‘আজ সমাপনী পরীক্ষার ফল প্রকাশ!’ প্রথমে শিক্ষামন্ত্রী দুপুর ১২টায় আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল প্রধানমন্ত্রীর হাতে হস্তান্তর করবেন। এরপর বেলা দুটো থেকে ফলাফল ইন্টারনেটে বা পরীক্ষার কেন্দ্রে গিয়ে জানা যাবে।
সকাল থেকে জনির কেমন জানি অস্থির অস্থির লাগছে। কোনো কিছু খেতেও ভালো লাগছে না, কারো সাথে কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। কাউকে বুঝাতেও পারছে না। মনের ভেতর এক অজানা শঙ্কা যেন বাসা বেঁধে আছে। পরীক্ষায় পাস করেছি তো, নাকি….আরো কত কী!
রনি ও জনি ফলাফল প্রকাশের নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই কেন্দ্রে এসে উপস্থিত। অভিভাবক ও ছাত্র-ছাত্রীদের হট্টগোলে পুরো হলরুম গম গম করছে।
হঠাৎ পুরো হলরুম নীরব-নিস্তব্ধ হয়ে গেল। চারদিকে বিরাজ করছে পিনপতন নীরবতা। প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে ফলাফল পত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছেন সলিম স্যার। তিনি প্রথমে ঘোষণা করলেন, ‘আমাদের এ বিদ্যালয়ের গৌরব রনি বরাবরের মতো সমাপনী পরীক্ষায়ও এ প্লাস পেয়ে এ বিদ্যালয় ও পিতা-মাতার মুখ উজ্জ্বল করতে সমর্থ হয়েছে।’ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রনিকে তার বাবা-মা জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করলেন।
একে একে সবার ফলাফল ঘোষণার পর জনির সিরিয়াল এলো। ঘোষক বললেন, ‘পঞ্চাশ নাম্বার সিরিয়ালের জনি জিপিএ ৪.৫০ পেয়ে প্রথম বিভাগে পাস করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।’ সাথে সাথে জনি রনিকে জড়িয়ে ধরে আনন্দের আতিশয্যে আনন্দাশ্রুতে ভাসিয়ে দিতে শুরু করলো। সে যেন বিশ্ব জয় করে এইমাত্র ফিরেছে আপন নীড়ে!
0 Response to "প্রকৃত বন্ধু -মুনাওয়ার শাহাদাত "
Post a Comment